ড. নয়ন বাঙালি
আমরাই একমাত্র বড়াই করার মতো জাতি, যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যক্তিস্বার্থ ও আত্মকেন্দ্রিকতার ঊর্ধ্বে উঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কমিউনিটিভিত্তিক সামাজিক সংগঠন গঠনের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছি। হয়তো অনেকেই এই সাংগঠনিক তৎপরতাকে নেতিবাচকভাবে দেখেন। কিন্তু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে অনুধাবন করা যাবে, এই নেতৃত্বের যে ধারাবাহিকতা এবং সেই সঙ্গে সংস্কৃতি, তা বিশ্বের অন্য কোনো জাতির মধ্যেই বিরল। আমরা আমাদের এই সাংগঠনিক শক্তিগুলোকে অর্থহীন করতে চাই না এবং সেই সঙ্গে বায়বীয় কোনো ধারা, যা অকার্যকর হয়ে মাঠে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। বরং চেষ্টা থাকবে এই নেতৃত্বের ক্ষমতা বিশ্বের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে যেন অনুসরণীয় হয়। তবেই আমাদের এ ধরনের সামাজিক নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা হবে দৃষ্টান্ত। আমি মূলত দেশের বাইরে বাংলাদেশিদের সাংগঠনিক তৎপরতাকে ইঙ্গিত করে লেখাটি লিখছি।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সংগঠন করার প্রবণতা রয়েছে অনেক এবং সেই প্রবণতা যে শুধু রাজনৈতিক সংগঠন করার জন্য তা নয়! কারণ অনেক মানুষ রাজনীতি অপছন্দ করলেও তারা ক্লাব, সমিতি, পেশাজীবী সংগঠন, চ্যারিটি ফোরাম ইত্যাদি বিভিন্ন পরিসরে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে চায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই প্রবণতা বা কোথা থেকে আসে এই উৎসাহ-উদ্দীপনা।
পোড় খাওয়া এই জাতির সামাজিক নেতৃত্ব দেওয়ার এই যে বিশাল আবেগ, তা এক দিনে হয়নি। কেননা এই জাতি তাদের মুখের ভাষার জন্য লড়াই করেছে এবং স্বাধীন ভূখণ্ড পরাধীনতার হাত থেকে রক্ষা করে নিজেদের ঐক্য প্রমাণ করেছে বিশ্ব দরবারে। বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশিরা যে এক অনন্য জাতি, তা জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলা ভাষাকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়। আমরা কি বিশ্বের প্রতিটি দেশে যারা যেখানে রয়েছে, তারা এই দিবসকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের কাছে বলে পালন করে আমাদের ঐতিহ্য তুলে ধরার যে সুযোগ, তা শক্ত হাতে করতে পারি নাÑঅবশ্যই পারি। করছিও বটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ছোটবেলা থেকে একটি লাইন আমরা পড়ে আসছি এবং তা পালন করছি, তা হচ্ছে ‘মানুষ সামাজিক জীব এবং সামাজিক সম্পদ সৃষ্টি করাই মানুষের কাজ।’
ধরুন আপনি থাকেন টেক্সাসে এবং দেখবেন যে সমাজে বাস করছেন, সেখানে কেউ কারও খবর রাখে না। পক্ষান্তরে একটি বাঙালি সমাজে গিয়ে দেখেন, দিন-রাত এক বাড়ির মানুষ আরেক বাড়ি দাবড়ে বেড়াচ্ছে, এ বাড়ির রান্না ওই বাড়িতে বিলিয়ে খাবার ভাগ করে খাচ্ছে। মানুষকে খাইয়ে কী না মজা পাচ্ছে। পাশ্চাত্যের সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক দল গঠনের জন্য তিনটি উপাদানকে মুখ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যেমন আকর্ষণ অর্থাৎ একে অন্যকে ভালোবাসে-পছন্দ করে, আনন্দবোধ করে; দ্বিতীয়ত, সম্মান অর্থাৎ সবাই একসঙ্গে থাকাকে সম্মানবোধ করে; তৃতীয়ত, নির্ভরশীলতা অর্থাৎ যে কাজ একা সম্ভব নয়, তা সবাই মিলেমিশে একে অন্যের সহায়তা নিয়ে করে ফেলা সম্ভব।
এই বাংলাদেশেই জন্ম নিয়েছেন সামাজিক ব্যবসার জনক ড. মুহাম্মদ ইউনুস, যিনি নোবেল বিজয়ী। আমরা বিশ্বের বুকে উঁচু গলায় বলতে পারি, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সামাজিক সংগঠন ব্র্যাক আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত বা জন্ম নিয়েছে। তাই সে দেশের মানুষ সংগঠক না হয়ে যাবে কই! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এই গর্বের ঢোল আমরা কি বাজাই দুনিয়াজুড়ে, নাকি শুধু দিশেহারা হয়ে সংগঠনের পর সংগঠন গড়েই যাচ্ছি? মনে রাখতে হবে, প্রতিটি কর্মের একটি সুন্দর যোগফল বা পরিণতি প্রয়োজন। আমরা কিছু দেশপাগল নির্বাসিত মানুষ গড়তে যাচ্ছি কুল অব লিডারশিপ-নেতৃত্ব উন্নয়ন নিয়ে কাজ করবে। সেই সঙ্গে আমাদের সহযোগী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেন্ট ফাউন্ডেশন, তারা কাজ করবে পৃথিবীব্যাপী যত বাংলাদেশি রয়েছে এবং তাদের যেসব জেলা, উপজেলা, গ্রামভিত্তিক সমিতি, ক্লাব, অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে, সেগুলোর ওপর ডেটাবেস তৈরি করবে। সেই সঙ্গে তাদের এ ধরনের কাজের কারণে সমাজ, কমিউনিটি, দেশ যেভাবে উপকৃত হচ্ছে, তা নিবন্ধ আকারে প্রকাশ করে প্রচার চালাবে, যাতে করে সারা বিশ্ব যেন দেখে, এই দেশ সামাজিক কাঠামো গঠনের এক শক্তিশালী তীর্থস্থান। এই দেশের মানুষের কর্মতৎপরতার কৌশল, স্টাইল, প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা হবে। পাশাপাশি আমার প্রত্যাশা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সামাজিক নেতৃত্ব, সামাজিক আন্দোলন নিয়ে অনুকরণীয় ল্যাব তৈরি হবে। সারা বিশ্বের ছাত্রছাত্রীরা তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের সংগঠনগুলোর কাছে আসুক। সেটা হোক নিউইয়র্ক বা যেকোনো স্থানে অবস্থিত বাংলাদেশের কোনো উপজেলা বা গ্রামের সমিতি, যাদের কাছ থেকে শিখবে কীভাবে তারা কমিউনিটির জন্য দল, সমাজকর্ম পরিচালনা করছে।
সমাজবিজ্ঞানী এরননের মতে, দুই বা ততোধিক ব্যক্তি যখন এমনভাবে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে যে তাদের প্রত্যেকের অস্তিত্ব পৃথকভাবে কোনো প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহৃত হয়, তখন সে জনসমষ্টিকে দল বলা হয়।
ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ লোকের সমষ্টি যাদের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে এবং যারা নিজেদেরকে একক সত্ত্বা হিসেবে মনে করে, তাদের সামাজিক দল বলা হয়। অন্যদিকে অর্থাৎ সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি সামাজিক দল সচেতন অথবা অসচেতনভাবে কার্যক্রম গ্রহণে সক্ষম হতে হবে।
গবেষকদের মতে, দল গড়ে ওঠার মূল প্রেরণা হলো একটি নির্দিষ্ট সমষ্টির মধ্যে সাধারণ স্বার্থ। সামাজিক দলের ধারণা প্রসঙ্গে সর্বস্বীকৃত সংজ্ঞা প্রদান করেন সামাজিক বিজ্ঞানী Samuel Koenig. তার মতে, ‘A group, a collection of persons must be organised, at best to the point of loving some means of discipline’ অর্থাৎ দল হলো কতগুলো মানুষের সংঘবদ্ধ অবস্থান, যেখানে কতিপয় নিয়মরীতি থাকতে হবে। অর্থাৎ সামাজিক দল হলো ব্যক্তির মধ্যে সংগঠিত চুক্তি, যার সদস্যদের মধ্যে সাধারণ লক্ষ্য, স্বার্থ, উদ্দীপনা এবং পারস্পরিক আবেগ, সম্পর্ক ও আন্তক্রিয়া বজায় থাকে।
আমার এই লেখার প্রাসঙ্গিক কিছু লক্ষ্য আছে, তা শুধু সামাজিক সংগঠন গঠনের উদ্দেশ্য নয়, বরং জাতি হিসেবে বাংলাদেশের বাঙালিরা অনেক বেশি মাত্রায় গতিশীল ও পরোপকারী। তাই বিদেশের মাটিতে একজন সাদা চামড়ার মানুষ কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। কিন্তু আমরা দিনরাত মানুষের জন্য কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই কত কিছু যে করে যাই, তার কোনো সীমা নেই। হয়তো পরিশেষে যৌক্তিকভাবেই আমরা একটু সম্মান চাই। আমাদের ক্লাব সমিতি মানে একটি কমিউনিটির জন্য স্বেচ্ছায় কিছু করাÑরান্না করে খাওয়ানো, অভাবীদের সাহায্য এবং কমিউনিটির কলেবর বাড়ানো। আমাদের কাজগুলো বিশ্বের সেরা কাজ। আমাদের যারা বলে খামোখা বাংলাদেশ বা বেকার সমিতি করা মানুষ, তারা ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। আমি তো হলফ করে বলতে পারি, আমাদের এই প্রবণতা বিশ্বের যেকোনো জাতি-গোষ্ঠী থেকে অনেক সমাজকেন্দ্রভিত্তিক, যেখানে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা নেই বললেই চলে।
আমরা সমষ্টিগত চিন্তা করি, যা করেছিলেন সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার। তিনি তার ‘সোসাইটি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘whenever the member of any group small or big live together in such a way that they share, not this or that particular interest but the basic conditions of a community life, we call that a group community.’ তার মানে কমিউনিটি তৈরি, রক্ষা বা পালন সব আমাদের মানুষ দ্বারা হচ্ছে। ভারত তো আমাদের থেকে বিশাল বড় এক দেশ কিন্তু তারাও কি এই সমাজ, সমিতি, উৎসবের দৌড়ে বিদেশের মাটিতে আমাদের থেকে বেশি দৌড়াতে পারবে। না সম্ভব নয়, তারা যদি বলে যে তারা আইটিতে অনেক এগিয়েছে, আমি বলব আমাদের বাংলাদেশিরা সমাজ উন্নয়নের মূল জায়গায় অগ্রগামী, যেখানে আবেগ আছে, ভালোবাসা আছে, প্রশান্তি আছে, যা বেঁচে থাকার জন্য অনিবার্য।
লক্ষ করবেন, এ দেশের প্রতিটি স্কুলে এক্সট্রা কারিকুলাম তথা ছাত্রছাত্রীদের ক্লাব অ্যাক্টিভিটি করতে হয় অর্থাৎ ওদের সামাজিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য উপযোগী করে তোলার এক মহাপরিকল্পনা, যেখানে আমরা এই ধারায় বহু আগে থেকেই মানসিকভাবে শক্ত অবস্থানে। সেদিন আর বেশি দূরে নেই, যখন বাঙালিদের নিয়ে ওরা পর্যালাচনা করবে যে আমরা কীভাবে এত উৎসাহ-উদ্দীপনা পাই।